
ধানের কারেন্ট পোকা / বাদামি গাছ ফড়িং দমনের কার্যকর কীটনাশক ওষধ
ধানের ক্ষেতে কারেন্ট পোকা:
ধানের ক্ষেতের কারেন্ট পোকা হলো বাদিম গাছ ফড়িং (BPH) ও সাদা পিঠের গাছফড়িং (WBPH). এই পোকাটি দেখতে খুবি ছোট ছোট। এরা বিভিন্ন সংখ্যায় থাকে এবং ধানের গোড়ার দিকে বসে ধান গাছের রষ চুষে খাই অনেক ক্ষেত্রে আক্রমণ অনেক বেশি হলে এরা উপরের দিকে উঠে আসে। ধানের কারেন্ট পোকা মূলত কলোনি বা দলবদ্ধ আকারে বসবাস করে। এরা দলবদ্ধ ভাবে ধানে আক্রমণ করলে মাত্রা ৩-৫ দিনের ভিতরেই সম্মপুর্ণ ধান ক্ষেতকে সম্পুর্ণ ভাবে ধ্বংস করে। এই পোকাগুলি ধান গাছের রষ চুষে খেয়ে জীবনধারণ ও বংশ বিস্তার করে, নিচে কারেন্ট পোকার জীবনকাল, পোকা প্রতিরোধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দমনের কার্যকর সমাধান ও কীটনাশক।
ধান ক্ষেতের কারেন্ট পোকার জীবনকাল:
কারেন্ট পোকা ডিম থেকে বের হওয়ার পরে ১৫-২১ দিন বেচে থাকে। একটি কারেন্ট পোকার মাতা বা স্ত্রী পোকাগুলি তার বয়স কালে ২০০ - ৪০০ টি ডিম দেয় কিন্তু এটি তার পর্যাপ্ত অনুকূল পরিবেশ পেলে ৫০০ টির বেশি ডিম দিতে পারে। কারেন্ট পোকা ডিম থেকে মারা যাওয়া সময়কাল হলো সর্বোচ্চ ৩০ দিনের ভিতর। এই পোকার ডিম থেকে বাচ্চা তৈরি হতে সর্বোচ্চ ৬-৯ দিন সময় লাগে।
যে সকল ধান ক্ষেতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ বেশি হয়:
যে সকল ধান ক্ষেত নিচু জমিতে অবস্থিত বা জমির মাটি গুলো স্যাতস্যেতে থাকে এই জমিতে কারেন্ট পোকার আক্রমণ বেশি দেখাযাই। এছাড়াও জমিতে অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারে এই পোকার আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ও জমিতে কম আলো প্রবেশ ও ধান ঘন করে রোপ করা হলে এই পোকার আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি হয়। এই কারেন্ট পোকা আলোউপর আকৃষ্ট হয়, তাই বৈদ্যুতিক বাতির কাছের জমিতে বেশি আক্রমণ দেখা যায়।
- ধান জমিতে পানি বা মাটি স্যাতস্যেতে হলে এই পোকা বেশি আক্রমণ করে
- অতিরিক্ত ইউরিয়া বেশি ব্যবহার করলে গাছ খুব নরম ও রসালো হয় পোকা সহজে আক্রমণ করে।
- ভিজে ও আর্দ্র পরিবেশে এদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে।
- বাতাস চলাচল কম হয়, জমি আর্দ্র থাকে পোকা দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
- এরা আলো আকৃষ্ট হয়, তাই বৈদ্যুতিক বাতির কাছের জমিতে বেশি আক্রমণ দেখা যায়।
ধান ক্ষেতে কারেন্ট পোকা আক্রমণের লক্ষণ:
ধানক্ষেতে প্রথমে পাতার গোড়া হলুদ হয় পরে গাছ বাদামি ও শুকিয়ে যায় শেষে পুরো ক্ষেত আগুনে পোড়া মতো দেখাযাই ও গোল গোল শুকনা ছাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এটিই কারেন্ট পোকা বা BPH আক্রমণের চূড়ান্ত লক্ষণ। প্রচন্ড আক্রমণ হলে ৩-৫ দিনের ভিতরেই আক্রান্ত ধান ক্ষেতকে ম্পুর্ণ ভাবে ধ্বংস করতে পারে।
- প্রথম দিকের লক্ষণ: গাছের গোড়ায় বাদামি ফড়িং দলবদ্ধভাবে জমে রস চুষতে শুরু করে। এতে গাছ দুর্বল হয় এবং পাতার গোড়ার দিক থেকে হলুদাভ রং ধারণ করে । এই আক্রমণে ধান গাছগুলি মারা যেতে ১০–১৫ দিন সময় নেয়।
- মধ্যবর্তী অবস্থা: পোকার সংখ্যা বাড়তে থাকলে গাছের সবুজ ভাব খুবি দ্রুত কমে যায়, ধীরে ধীরে পাতা ও কাণ্ড বাদামি হয়ে শুকাতে থাকে। আক্রান্ত জমিতে পানি থাকলেও গাছ ঝিমিয়ে পড়ার মতো দেখা যায়।
- গুরুতর আক্রমণ (Hopper Burn): যখন প্রচুর পোকা একসাথে আক্রমণ করে, তখন পুরো ক্ষেত আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো গোল গোল চাকের ন্যায় বাদামি ও শুকনো দেখাই এই লক্ষণকে হপার বার্ন বলে। প্রচন্ড বা গুরুতর আক্রমনে ধান গাছগুলি মারা যেতে ৩-৫ দিন সময় নেয়। দূর থেকে দেখে মনেহয় আক্রান্ত স্থানে কেউ আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো।
- ফলনের উপর প্রভাব: আক্রান্ত গাছ দুর্বল হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, কুশি বের হয় না, শীষ ছোট বা ফাঁপা হয়ে যায় এবং ধানের ফলন তীব্রভাবে কমে যায়।
কারেন্ট পোকা প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
- নিয়মিত ধান ক্ষেত পরিদর্শন করুন এবং ধান ক্ষেতে কোনো অদ্ভুত ভিন্নতা আছে কী ভালোভাবে লক্ষণ করুন।
- সুষম সার ব্যবহার: ইউরিয়া/নাইট্রোজেন ব্যবহার কমানো, পর্যাপ্ত পটাশ ও জিপসাম ব্যবহার করলে গাছ শক্ত হয়, পোকার আক্রমণ কমে।
- ঘনবীজতলা ও ঘন রোপণ এড়িয়ে চলা এতে বাতাস চলাচল বাড়ে, জমি শুকনো থাকে।
- জমি শুকনো রাখা → সবসময় পানি জমে থাকতে না দেওয়া, মাঝে মাঝে জমি শুকানো।
- ধান ক্ষেতে মাকর্শা পোকা রাখা এরা কারেন্ট পোকা খেয়ে এই পোকা দমন করে। এইজন্য ক্ষতিকর কীটনাশক প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।
ধানক্ষেতে কারেন্ট পোকা (BPH) প্রতিরোধ করতে হলে সুষম সার প্রয়োগ, জমি শুকনো রাখা, ঘন রোপণ এড়িয়ে চলা, প্রাকৃতিক শিকারি পোকা যেমন মাকর্শা সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনে উপযুক্ত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
কারেন্ট পোকা দমনে কীটনাশক:
ধান ক্ষেতে কারেন্ট পোকা দমনের জন্য সমস্ত নিদ্রিষ্ট কিছু কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। কারেন্ট পোকাগুলি মূলত ধান গাছের গোড়ায় বেশি অবস্থায় করে এতে সাধারণ কীটনাশক স্প্রে দিলে বিষ ধান গাছের গোড়ায় পোছাই না তাই পোকাগুলি সহযে দমন হয় না। তবে এই পোকা দমনে প্রচন্ড অন্তর্বাহী ক্ষমতা গুণসম্পন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করলে পোকাগুলি ভালো ভাবে দমন করা যাই । এই প্রচন্ড অন্তর্বাহী কীটনাশক প্রয়োগ করলে এই বিষ পাতার মাধ্যমে শোষিত হয়ে সমস্ত ধান গাছের শরীরে পোছে যাই এবং গোড়ায় থাকে কারেন্ট পোকা যখন এই বিষ যুক্ত রষ খাই ঠিক তখন পোকাগুলি মারা যায়। তাই এইজন্য প্রচন্ড অন্তর্বাহী গুপের কীটনাশক যেমনঃ ইমিডাক্লোপ্রিড, নিটেনপাইরাম, পাইমেট্রোজিন বাংলাদেশে জনপ্রিয় কারেন্ট পোকা দমনের কীটনাশকের নাম নিচে দেওয়া হলো
কারেন্ট পোকা দমনের কীটনাশকের নাম:
- লকডাউন ৭০ ডব্লিউডিজি (পাইমেট্রোজিন + নিটেনপাইরাম)
- স্পেলেন্ডর ৮০ ডব্লিউডিজি (পাইমেট্রোজিন + নিটেনপাইরাম)
- পাইরিড প্লাস ৭০ ডব্লউডিজি (পাইমেট্রোজিন + নিটেনপাইরাম)
- জি প্লে ৬৮ ডব্লিউডিজি (ইমিডাক্লোপ্রিড + পাইমেট্রোজিন )
- ইস্ট ভেনিস ৮০ ডব্লউডিজি (পাইমেট্রোজিন + নিটেনপাইরাম)
- ভেসটরিয়া ২০ ডব্লিউজি (ট্রাইফ্লুমেজোপাইরিম ২০%) ইত্যাদি
কারেন্ট পোকা দমনের কীটনাশক গুলি জমিতে স্প্রে দেওয়ার সময় অবশ্যই পর্যাপ্ত বেশি বেশি কীটনাশক যুক্ত পানি ধান ক্ষেতে স্প্রে দিতে হবে তাহলে সর্বোচ্চ রেজাল্ট পাওয়া সম্ভব। ৩৩ শতাংশ জমির জন্য মিনিমাম ৪৮ লিটার পানি প্রয়োগ করতে হবে।